কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল টি।
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল |
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল
উত্তর : ভূমিকা : কারবালা হত্যাকাণ্ড মুসলিম বিশ্বের তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক দুঃখজনক ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ইসলামের ঐক্য ও শান্তি বিনষ্ট হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের শেষ আশাটুকু ও চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে উমাইয়া খিলাফতের সকল প্রকার বাধা দূরীভূত হওয়ার বদলে খিলাফতের পথকে আরও কণ্ঠকাকীর্ণ করে তোলে।
→ হত্যাকাণ্ডের কারণসমূহ : ক্ষমতার লোভই কারবালা হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. চুক্তির অবমাননা : মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের সাথে সম্পাদিত চুক্তির অবমাননা করে স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে ৬৭৯ সালে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। মুয়াবিয়া চুক্তি ভঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ ইয়াজিদকে খলিফা পদে মনোনয়ন দান নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারেননি এই ঘটনা কারবালা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
২. ধর্মীয় নেতাদের অসন্তুষ্টি : ইয়াজিদ ছিলেন একাধারে নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক। শাসনের ক্ষেত্রে তিনি ন্যায় অন্যায়ের কোনো ধার ধারতেন না। তিনি লম্পট ও দুশ্চরিত্রবান প্রকৃতির ছিলেন এবং মদ্যপানে আসক্ত ছিলেন। তাই বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মীয় নেতাগণ তার এই আচরণে অসন্তুষ্ট হন।
৩. ইয়াজিদের খিলাফতের বিরোধিতা : ইয়াজিদ অবৈধভাবে খিলাফতে আরোহণ করলে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং খিলাফত অস্বীকার করেন। তিনি ইসলামের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য জিহাদের সংকল্প গ্রহণ করেন।
৪. হুসাইনকে খলিফা ঘোষণা : ইয়াজিদ তার পিতার মতো দক্ষ শাসক ছিলেন না। তিনি লম্পট ও দুশ্চরিত্রবান ছিলেন। তাই মক্কা ও মদিনার জনগণ তার খিলাফত মেনে নিতে পারেনি। তারা ইয়াজিদের খিলাফতকে অস্বীকার করে হুসাইনকে তাদের খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে। এতে ইয়াজিদ ক্ষুব্ধ হয়ে হুসাইন (রা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
৫. মারওয়ানের ষড়যন্ত্র : ইয়াজিদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর ও ধূর্ত। তিনি ইয়াজিদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে খিলাফত লাভের আশায় হুসাইনের বিরুদ্ধে ইয়াজিদকে প্ররোচিত করে।
৬. কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা : কুফার জনগণের বিদ্রোহাত্মক ও বিশ্বাসঘাতক মনোভাব কারবালা হত্যাকাণ্ডের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল। তারা উমাইয়া শাসনের অভিশাপ হতে মুক্তিলাভের জন্য ইমাম হুসাইনের সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু ইতোমধ্যে ইয়াজিদ কুফাবাসীর উপর চাপ প্রয়োগ করলে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে এবং হুসাইনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
৭. যুবায়েরের দুরভিসন্ধি : ইমাম হুসাইন (রা.)-এর খিলাফত লাভের ন্যায্য দাবিকে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুর রহমান সমর্থন করেন। কিছুদিন পর শেষোক্ত দুই ব্যক্তি ইয়াজিদের প্রলোভনে পড়ে তার বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ইয়াজিদের কর্তৃত্ব সহ্য করতে না পেরে মক্কায় চলে যান। যুবায়ের হুসাইনের অবর্তমানে খলিফা হবার গোপন ইচ্ছা পোষণ করতেন। তাই তিনি হুসাইনকে স্বীয় পথ হতে অপসারণের জন্য ইয়াজিদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন।
৮. মুসলিমের হত্যাকাণ্ড : ইমাম হুসাইন (রা.) মুসলিমকে কুফায় প্রেরণ করেন সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হুসাইনকে কুফা অভিযানের জন্য এক পত্র প্রেরণ করেন। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ এই সংবাদ শুনে মুসলিমকে হত্যা করে । যা কারবালার সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে।
৯. গোত্রীয় বিরোধ : গোত্রীয় বিরোধ কারবালা হত্যাকাণ্ডের আরেকটি অন্যতম কারণ। উমাইয়া এবং হাশেমীদের মধ্যে চিরাচরিত গোত্র বিরোধ আলী মুয়াবিয়া থেকে শুরু করে ইয়াজিদ-হুসাইনের মধ্যে বিবাদকে আরও চাঙ্গা করে তোলে ।
১০. উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ : মদিনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী সিরিয়ার গুরুত্ব হেজাজ অপেক্ষা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং সেখানকার লোকজন মৌলিক ইসলামি আদর্শের পরিপন্থি কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। মক্কা ও মদিনার ধর্মপ্রাণ সৎ সাহাবিগণ এই অনাচার ও অনুদার মনোভাবের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। এ কারণে মক্কা ও মদিনার জনগণ হুসাইনকে সমর্থন করেন। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইয়াজিদ হুসাইনকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
→ কারবালা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা : ইমাম হুসাইন কুফাবাসীদের সাহায্যে আশ্বস্ত হয়ে ৬৮০ খ্রি. কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ওবায়দুল্লাহ হুসাইন ও তার পরিবারকে অবরুদ্ধ করে। ওবায়দুল্ল াহ তাদেরকে ফোরাত নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করলে হুসাইনের শিবিরে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ১০ই মহররম যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ভ্রাতুষ্পুত্র কাশেম প্রথমে শাহাদাত বরণ করেন। পরে পিপাসার্ত ইমাম হুসাইন পুত্র আসগরকে নিয়ে ফোরাত নদীতে পানি পানের জন্য অগ্রসর হলে শত্রুরা শরবিদ্ধ করে। শত্রুদের অপর একটি শরের আঘাতে তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। নিষ্ঠুর ও পাপিষ্ঠ সীমার হুসাইনের মস্তক ছিন্ন করে এবং ১০ই মহররম তিনি শাহাদত বরণ করেন। একমাত্র পুত্র জয়নুল আবেদীন ব্যতীত পরিবারের সকল পুরুষই শহিদ হন। ঐতিহাসিক গীবন বলেন, “সেই দূরবর্তী যুগেও আবহাওয়া হুসাইনের মৃত্যুর শোকাবাহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের অন্তরের সমবেদনা সঞ্চার করবে।”
কারবালা হত্যাকাণ্ডের ফলাফল : কারবালার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এ ঘটনার পর ইসলামের মোড় ঘুরে যায়। নিচে এর ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. ইসলামি ঐক্য বিনষ্ট : কারবালার মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড ইসলামি ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের মূলে কুঠারাঘাত করে। এর ফলে মুসলমানদের জাতীয় ঐক্য ধসে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের গোত্র কলহ সৃষ্টি করে।
২. রাজনৈতিক বিপর্যয় : কারবালা যুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য একটি রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। এই রাজনৈতিক বিপর্যয় প্রথমে উমাইয়া খিলাফতের সর্বনাশ ডেকে আনে এবং পতনকে ত্বরান্বিত করে। পরবর্তীতে অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে এ বিপদ সৃষ্টি করে ।
৩. শিয়া মতবাদের জন্ম : কারবালার ঘটনা মুসলিম সমাজকে দ্বিধা বিভক্ত করে এবং শিয়া মতবাদের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে শিয়ারা শুধু একটি দল নয় একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক পি.কে. হিট্টি বলেন, “হুসাইনের রক্ত তার পিতার রক্ত অপেক্ষাও বেশি করে শিয়া মতবাদের বীজ রোপণ করে ১০ মহররম শিয়া মতবাদের জন্ম হয়। এ ঘটনার পর হতে শিয়ারা মহরম এর প্রথম ১০ দিন শোক দিবস পালন করে।
৪. পারস্য জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান : কারবালার যুদ্ধ আসলে ছিল আরবদের দুই দলের মধ্যে একটি সংগ্রাম। কিন্তু কালক্রমে এটা আরব ও পারস্য এই দুই জাতির মধ্যে সংগ্রামের রূপ ধারণ করে। এ উদ্দীপনা পরবর্তীকালে উমাইয়াদের ধ্বংস সাধনে আব্বাসীয় বংশধরদের সহায়তা করেছিল।
৫. মক্কা ও মদীনায় বিদ্রোহ : কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল যুবায়েরের নেতৃত্বে পরিচালিত মক্কা ও মদিনার বিদ্রোহ। কারবালার ঘটনা মক্কা ও মদিনাবাসীকে কঠিনতম আঘাত হেনেছিল। তারা ইয়াজিদের নিকট হজরত আলীর বংশধরের উপর কৃত অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করলো।
৬. আব্দুল্লাহর খলিফা পদ ঘোষণা : আব্দুল্লাহ কারবালার দুঃখজনক ঘটনা শোনামাত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মক্কা ও মদীনার জনগণ তাকে সমর্থন জানালো। সুযোগ বুঝে আব্দুল্লাহ নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করল। এ খবর পেয়ে ইয়াজিদ মক্কায় একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে তাকে দামেস্কে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
→ হাররার যুদ্ধ : মদিনা বাসীগণ ইয়াজিদের অপকর্ম জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াজিদের পদচ্যুতি ঘোষণা করে এবং তার নিযুক্ত শাসন কর্তাকে মদিনা হতে বিতাড়িত করে। ইয়াজিদ মুসলিম বিন উবার নেতৃত্বে মদিনা আক্রমণ করেন এবং হাররার যুদ্ধে মদিনাবাসীগণ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
১. কাবাগৃহের ধ্বংস সাধন : মদিনা ধ্বংসের পর ইয়াজিদ বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হলে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের নিজেকে সেখানকার খলিফা বলে ঘোষণা করেছিল। ৬৮৩ সালে হুসাইন বিন নুসাবের নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন। হুসাইন বিন নুসার মক্কা অবরোধ করেন এবং কাবা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রাসাদের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন।
২. উমাইয়া হাশেমী বিরোধ : কারবালা হত্যাকাণ্ড পূর্বের উমাইয়া হাশেমী বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করে। কারবালা হত্যাকাণ্ড উমাইয়াদের দৃষ্টিতে ছিল হাশিম গোত্রের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ ৷ তা ৭৫০ খ্রি. যাবের যুদ্ধে উমাইয়ারা পরাজিত হলে আব্বাসীয়রা এর প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
৩. শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব : এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য দিক হলো শিয়া সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি এ বিরোধ ইসলামের ঐক্য সংহতিকে চিরতরে ধ্বংস করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কারবালার বিষাদময় ঘটনা শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয় বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি দুংখজনক ও কলংকজনক অধ্যায়। পরবর্তীতে এটা কোনো সুফল বয়ে আনেনি বরং ধ্বংস ও বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল। তাই ঐতিহাসিক মূর বলেন, “কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা কেবল খিলাফতের ভাগ্যই নির্ধারণ করেনি, এটা খিলাফত ধ্বংসের অনেক পরে মুসলিম জাহানের ভাগ্য ও নির্ধারিত হয়েছিল।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার কারণ ও ফলাফল টি। যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।