বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল ।
বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল |
বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল
উত্তর : ভূমিকা : সংস্কৃতি হলো একটি জাতির সার্বক্ষণিক রূপ। অর্থাৎ মানুষ তার যে সার্বিক কাজ সম্পূর্ণ করে সেইগুলোই সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন জাতি ধর্মের লোক তাই আমাদের সংস্কৃতির উৎস ও ভিত্তি, অস্তি ও মজ্জা আজো আদিম। মানুষ নতুন নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে ভালোবাসে। তারা অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় গতানুগতির জীবনযাপন করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় মানুষের অর্জিত আচরণ পরিস্রুত জীবন চেতনা । প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে যেসব বণিক, পর্যটক প্রচারক বাংলাদেশে এসেছে তারা বাঙালিকে ভীরু, মিথ্যাবাদী প্রতারক ও দরিদ্র বলে জেনেছে। বাঙালি বিভিন্ন শাসক দ্বারা শাসিত ও শোষিত তাই চিত্ত বিকাশের সুযোগ মিলেনি তাদের। তাই সংস্কৃতির এ সচল প্রবাহই বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার পেছনে দায়ী । নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা : বাঙালি জীবন বিকাশে তেমন কোনো সুযোগ পায়নি, যেহেতু তারা শাসিত ছিল। বাঙালির সংস্কৃতি নদীর মতোই বহমান, গতিশীল নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির প্রবাহ সচল থাকে। আর এর মধ্যে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা গড়ে উঠে। বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে গড়ে উঠে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
২. আর্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ : আর্যরা বিজয়ী রূপে এদেশে এসেছে। আর এজন্যই তাদের সংখ্যা ছিল মোটামুটি সীমিত। এদেশে যখন আর্যরা বিজয় করে তখন সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের লোকেরা আর্যসমাজে মিশে গিয়েছিল । যেহেতু দাক্ষিণাতের দ্রাবিড়রা উচ্চবর্ণের আর্যশ্রেণিভুক্ত ছিল। আর্যদের বসবাসের সঙ্গে সঙ্গেই আর্যভুক্ত হতে শুরু করে উত্তর ভারত। আর্যরা বহু কাল ধরে প্রতাপের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল। এমনকি এক সময়ে যখন বিজেতা বিজিতের স্মৃতি গণমনে মুছে যাওয়ার উপক্রম হলো বেশির ভাগ অনার্য সমাজে হীন বর্ণরূপে লাঞ্ছিত, অবজ্ঞাত ও উৎপীড়িত হচ্ছিল । তখন জৈব নিয়মেই সেকালে ধর্ম বিপ্লবের সৃষ্টি হয় যার নেতৃত্ব দেয় বর্ধমানে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ। জর্জ গ্রিয়ার্সন গুজরাটী মারাঠীর সঙ্গে উড়িষ্যা বাঙলা, আসামীর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছিলেন। মনে করেছিলেন এ সাদৃশ্য আলপীয় বর্ণের আর্যভাষী নরগোষ্ঠীর প্রভাব। আবার বিভিন্ন গোত্রের অনার্যরা আর্য সাম্রাজ্যে দস্যু, ব্রাহ্মণ, যক্ষ নাগ, পক্ষী, কুকুর দৈত্য প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। মহাভারত ও পুরাণসমূহে অনার্যদের সম্বন্ধে নানা উদ্ভট কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অথচ যুগে যুগে আমরা জানতে পেরেছি কোনো কোনো অনার্য গোত্র বিশেষত দ্রাবিড়ের আর্যদের চেয়েও সভ্য ও উন্নত ছিল তার প্রমাণ মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও পাণ্ডুরাজার ঢিবি আর্য ধর্ম সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষভাবে পাচ্ছি।
৩. বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুপ্রবেশ : আর্য অনার্যের প্রভাব যখন ঘুচে গেল তখন দেশ বা মানুষ বিশেষের কাছে মহাবীরের বাণী পৌছিয়ে দেবার পক্ষে বেদনা বাধা রইল না। এ সময়েই প্রথম জৈন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মগধের সীমা অতিক্রম করে রাঢ়ে, পুণ্ড্র তথা আধুনিক বাংলাদেশে নবধর্ম প্রচারের জন্য উপস্থিত হন। এদেশের বর্বর প্রায় জনগণের সাধ্য আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির আবরণে এই দ্রোহী ধর্ম অর্থাৎ জৈন, বৌদ্ধ মতবাদ প্রচারিত হয়। এদের লিপি ছিল না সাহিত্যের শালীন ভাষা ছিল না, উঁচু মানের সংস্কৃতি ছিল না। তাই আর্য ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার লাভ করে। তখন সেই সুযোগে কিছু সংখ্যার তথা কথিত আর্য ও এদেশের প্রচার উপলক্ষ্যে বসবাস করতে শুরু করেছিল বাঙালির পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিল। পাল রাজাদের পৃষ্ঠাপোষকতার ফলে বৌদ্ধ ধর্ম টিকে ছিল। সেন রাজাগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
৪. অস্ট্রিক মঙ্গোলদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ : অস্ট্রিক মঙ্গোলদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। সেটাই চিরকাল বাঙালির স্ব-ধারা। আর তাদের এ প্রভাব হতে বাঙালি কখনোই মুক্ত হতে পারেনি। বাঙালির সে পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করেলেও মুছে ফেলা যাবে না। বাঙালির চিন্তায়, চেতনায় মস্তিষ্কে মননে, শিরা, উপশিরাই তা মিশে আছে যা যুগ যুগ ধরে চলছে। যেমন- সংখ্যা যোগ, তন্ত্র, দেহতত্ত্ব। এগুলো আর নারী দেবতা, পশুপাখি ও বৃক্ষদেবতা, জন্মান্তর প্রভৃতি হচ্ছে অস্ট্রিকদের দান! এগুলোর মধ্যে মন মানসিকতা ও মননের যে বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে তার প্রভাব থেকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ কখনোই মুক্ত ছিল না। আজো মুক্ত হয়নি ভবিষ্যতেও মুক্ত হবে না। এ বৈশিষ্ট্য বাঙালির চরিত্রে ও জীবনে অন্তর্নিহিত। বাঙালি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম প্রভৃতি ধর্ম গ্রহণ করে নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে কিন্তু কখনো সে সংখ্যা যোগ তন্ত্রের প্রভাব ছাড়তে পারেনি। ফলে বহিরাগত প্রতিটি রূপ এখানে এসে নতুন রূপ লাভ করেছে। নতুন চরিত্র নিয়েছে বাঙালি রূপ নিয়েছে।
৫. বিদেশি শাসন : বাংলার এ মাটিতে প্রাচীনকাল হতে বিদেশি ও বিজাতীয় শাসন বলবৎ ছিল। বাঙালি শাসকদের মধ্যে শশাঙ্ক-নরেন্দ্র-গুপ্ত যিনি সপ্তম শতকে এবং যদু জালাউদ্দীন যিনি পনেরো শতকে বাংলা শাসন করেছেন। এ দুজন ছাড়া বাংলায় তৎকালীন সময় পর্যন্ত কোনো বাঙালি শাসক ছিল না। এটি ছিল বাঙালিদের জন্য অবশ্যই লজ্জার এবং বাঙালির চরিত্রে নিহিত রয়েছে এর একাধিক কারণ। দীর্ঘকাল বিদেশি বিজাতি শাসনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই শাসক শ্রেণির সাংস্কৃতির অবাধ মেলামেশা বাঙালিয় সাংস্কৃতিতে ভাই-বোনের মত প্রবেশ করেছে। আর এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করেন নাই ।
৬. বিদেশি পর্যটক ও পরিব্রাজকের আগমন : অতীতে ধর্ম প্রচারক পরিব্রাজকের এবং বিদ্বানগণ ও পণ্ডিতগণ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐক্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে বিরোধের ফলে বিজয়ী এবং বিজেতার সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। আমাদের এ অঞ্চলে চীনের হিউয়েন সাঙ, মরস্কোর ইবনে বতুতা, ইতালির মার্কোপোলো প্রমুখ বিদেশি পর্যটক তথা পরিবারের আগমনে ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমন্বয়সাধনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
৭. ব্যবসা-বাণিজ্য : ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষ্যে বাঙালির ভূ- মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গমন এবং সেখানকার বণিকদের এদেশের আগমন ছিল যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার মাত্র। তাই ক্রিটবাসীর সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতির যোগ ছিল স্বাভাবিক। এর প্রমাণ উভয় দেশের মাতৃদেবীর বাহক সিংহ। ক্রিটবাসীর নারীরা দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতো, তেমনি বাস্তবায়নের বাসসূত্র থেকে জানা যায় যে অভিজাত নারীরা শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতো। ডক্টর অতুল সুরের মতে, ক্রিটে প্রচলিত লিপের সঙ্গে বাঙলার পাঞ্চ মার্ক যুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপির সাদৃশ্য ছিল। আলপীয় আর্যবাসীরা বণিক হিসেবেই এশিয়া মাইনর অ্যাশিরিয়া, দক্ষিণ ইরান হয়ে অসুর পন্থিরূপে বাঙলায় উড়িষ্যায় প্রবেশ করেছিল, যার ফলে এখানে আলপীয় নর গোষ্ঠীর বাহুল্য দেখা যায় এবং এজন্যই বৈদিক আর্যরা এ অঞ্চলের লোককে অসুর নামে অবহিত করতো। অসুর অ্যাশিরীয়দের পূজা এবং অহোরামজদের উপাসিক জোর তুন্ত্রের জন্ম অ্যাশিরীয় রাজ্য সীমান্ত অঞ্চলে ।
৮. নতুন ধর্মমত্ত্বের প্রচলন : বাঙালির দর্শনচিন্তাতে প্রভাবিত করেছে লৌকিক ধর্ম, জৈন ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, নাথ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম প্রভৃতি। বাঙালির এসকল ধর্ম সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদিতার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। যে কারণে সম্রাট আকবর উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক নিত্যনূতন ধর্ম যা দ্বীন ই-ইলাহী নামে পরিচিত
৯. বাঙালির দর্শন : আবহমান বাংলার সাংস্কৃতি কৃষ্টি, চিন্তা- চেতনা, মনন-সাধনা ও ধর্ম এসব মিলেয়েই গড়ে উঠেছে। বাঙালির উল্লেখযোগ্য দর্শনসমূহ হলো লোকায়ত দৰ্শন, বৈষ্ণব দর্শন, সুফি দর্শন, বাউল দর্শন, চার্বাক দর্শন প্রভৃতি। যা প্রকাশ পেয়েছে মানবতাবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে দিয়ে বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আমরা বাঙালিরা আজ যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি তা অনেক পুরানো। কারণ আমরা কাল বিচ্ছিন্ন নই, প্রবাহ বিচ্ছিন্ন নই। সুতরাং আবহমান কাল ধরে প্রবাহমান সংস্কৃতির ধারা তা বহু বিচিত্র প্রভাব এবং প্রতিবন্ধকতা ছড়িয়ে দেশের মাটির আপন পরিবেশে লালিত ও পরিপুষ্ট হয়েছে। উপরে উল্লিখিত বিষয়সমূহ মিলিয়ে আমরা বাঙালি আজ যে ঐশ্বর্য মণ্ডিত সংকর সাংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি তাই আমাদের বাঙালির মানস সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা সাহিত্য, জীবন পদ্ধতি ধর্ম, এসবের কোনটিই জাতীয় রূপ কল্পনা করা যায় না। তা করতে গেলে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হবে এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে ও ক্ষতি হবে।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কিভাবে ঘটেছিল টি। যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।