বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন |
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন
- বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব/ভূমিকা বর্ণনা কর ।
- অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
- অথবা, “১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সাহায্য করেছিল।” -উক্তিটি ব্যাখ্যা কর ।
- অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীন যাত্রা শুরু করে বাঙালিরা মনে করেছিল স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত পরিবেশে তারা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিকাশের পথ খুঁজে পাবে এবং তাদের স্বাধীন সত্তা নিয়ে বাঁচতে পারবে। বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয় এক স্বতন্ত্র জীবন প্রবাহে। কিন্তু বাঙালিদের এ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রয়াসে মেতে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। আর এ অপপ্রয়াসে প্রথম পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করে ভাষাকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে শত সহস্র বাঙালি কণ্ঠ ও সচেতন ছাত্রসমাজ তাদের প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষাকে কেঁড়ে নেবার বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। হাজার বছরের বাঙালির সুপ্ত জাতীয়তাবোধ এরই মধ্য দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
→ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব : বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ : জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে যে উপাদান অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ভাষা আন্দোলন তাদের মধ্যে অন্যতম। কারণ কোনো জনগোষ্ঠীর ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। যদি কোনো জনগোষ্ঠী একে অপরের ভাষা বুঝতে না পারে বা একই ভাষাভুক্ত না হয় তাহলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের কাজটি সহজেই সম্পন্ন হয় না। তাদের মধ্যে কোনো প্রকার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে না। তাই লক্ষ করা যায়, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির জীবনে এমন একটি অধ্যায় যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। বাঙালিরা এ সর্বপ্রথম নিজেদের একটি স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। তারা মনে করে যে তাদের রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। তারা কখনো পরাধীন থাকতে পারে না। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয়ে উঠে ।
২. আত্মসচেতনতাবোধ : ভাষা আন্দোলনের পূর্বে বাঙালি জাতির মনে এরূপ ধারণার জন্ম দেয় যে, পাকিস্তানের উভয় অংশের মুসলমানরা ভাই ভাই। তারা একে অপরের সুখে-দুঃখে, বিপদে- আপদে এগিয়ে আসবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালিরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সবসময় তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছে। তারা ভাইয়ের নামে, ধর্মের নামে বাঙালিদেরকে শোষণের নানা কৌশল প্রয়োগ করছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম লাভ করে যে, বাঙালি পাকিস্তানে অপর অংশে বসবাসরত জনসমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিধানেও বাঙালিরা আলাদা জাতিসত্তা। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, চালচলন সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বিচারেও বাঙালিদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনো মিল নেই। এ আত্মসচেতনতার ফলেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবোধের আত্মসচেতনা জাগ্রত হয়।
৩. জাতীয় চেতনার সূচক : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় চেতনার সূচক হিসেবে বিবেচিত। এটি বাঙালি জাতিকে এমন একটি সুতায় বেঁধে ফেলে যা তাদেরকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনার উজ্জীবিত হয়ে বাঙালিরা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, ১৯৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৬-এর ছয়-দফা কর্মসূচি, ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে ছড়িয়ে পড়ার ফলে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
৪. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিলুপ্তি : ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা প্রবলভাবে কাজ করেছিল । কারণ রাজনৈতিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সম্পূর্ণরূপে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৪৭ সালে যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সেই মুসলিম জাতীয়তাবোধের ভিত্তি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে উর্দু ভাষাভাষীরা ভাষা আন্দোলনের পর রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলায় ক্রমশ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে ।
৫. গণতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি : ভাষা আন্দোলন এদেশের | মানুষের মনে গণতন্ত্রের প্রতি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। বাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। অধিকাংশ মানুষ চেয়েছিল | বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু পাকিস্তান | সরকার অধিকাংশ মানুষের দাবিকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এরূপ স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বাংলার সাধারণ মানুষের মনে প্রকৃত গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। দাবি উত্থাপন, দাবি আদায়ে সোচ্চার এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন এ দেশের মানুষকে গণতন্ত্রকামী করে তোলে ।
৬. বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি : পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মুসলিম লীগ ছিল সামন্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির দল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন হলে বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের ফলে মধ্যবিত্তদের সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
৭. দেশীয় এলিট শ্রেণির বিকাশ : পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার এলিটদের স্বার্থে আঘাত হানে। এ এলিট শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে নিজেদের বিকাশ ঘটাতে পারছিল না। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হলে এ আন্দোলন সমর্থন দানের মাধ্যমেই এলিট শ্রেণির নিজেদের সংঘবদ্ধ করে তুলে ।
৮. ছাত্রসমাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি : পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যেকোনো দেশের রাজনীতিতে ছাত্রসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের অনেক দেশেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে । অনুরূপভাবে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে এদেশের ছাত্রসমাজের সংগ্রামী ভূমিকা ও আত্মদান তাদেরকে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা করে। তাই ৫২- এর পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের ভূমিকাকে সবসময় আকাঙ্ক্ষা করে আসছে। যার প্রতিফলন আমরা প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে লক্ষ করে থাকি।
৯. বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ : বাংলা ভাষা আজ নিজস্ব গৌরবে দীপ্তিমান। এ জাতির আত্মদান আজ বিফল হয়নি। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯৯ সালে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের মহিমার কথা বিদিত হয়েছে। বাঙালিরাও নিজেদের অহংকারী জাতি বলে পরিচয় দিতে পারছে। এমনকি আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিওন তাদের দেশে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দান করেছে।
১০. অর্থনৈতিক মুক্তি : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনই ছিল না, বরং এ আন্দোলনটি বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির পিছনেও অসামান্য অবদান রেখেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদেরকে অর্থনৈতিকভাবেও শোষণের পথ প্রশস্ত করার প্রয়াস পেয়েছিল। কারণ ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানি শাসকরা উপলব্ধি করেন যে, বাঙালিদের অর্থনৈতিক শোষণের ব্যাপারটি সহজ হবে না। কারণ তারা যদি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে তবে তা প্রতিহত করা খুবই কষ্টকর হবে তা ছাড়া বাঙালিরা যখন অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছে তখনই তারা ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
১১. স্বাধীনতা আন্দোলন : ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করে। কারণ এটিই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলন যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জনমনে প্রভাব বিস্তারকারী আন্দোলন । ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্ত নিকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা। ফলে সৃষ্টি হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১২. ঐক্যজোট গঠনের রীতি : ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজকে একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে এবং ছাত্র বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার শ্রেণির ঐক্যজোট গঠনের রীতির সূত্রপাত হয়। বাঙালিরা একটি বিষয় উপলব্ধি করেন যে, ঐক্যবদ্ধ থাকলে যেকোনো সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। তাই দেখা যায় যে, স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলামির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এ আন্দোলনে জয়লাভের ফলে বাঙালিদের আত্মবিশ্বাস আরও বহুগুণে বেড়ে যায় ।
১৩. সার্বজনীন সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি : উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী বহু আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তা কোনো সময়ই সার্বজনীন রূপ লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এ আন্দোলনে পূর্ব বাংলার আপামর জনগণ এক কাতারে চলে আসে। গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মুসলিম লীগ নেতা ছাড়া সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণ ভাষার প্রশ্নে একাত্মতা পোষণ করেন। এমনকি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বহু নেতা সরকারের ষড়যন্ত্রের সাথে একমত পোষণ না করে, বরং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তারা বাংলা ভাষার পক্ষে বিবৃতি দেন। আবার ক্ষমতাসীন দলের গণপরিষদের একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড ও সরকারের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের জন্য গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেন। ভাষা আন্দোলনই হলো প্রথম আন্দোলন যেটি সমগ্র বাঙালিদের সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি করে ।
১৪. অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চার করার সুযোগ : পাকিস্তানিরা অন্যায়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মায়ের ভাষা কেঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা মনে করেছিল বাঙালিরা ভীরু ও দুর্বল। তাদের সাথে যেমন আচরণই করা হোক না কেন তারা কখনো মাথা তুলে তার প্রতিবাদ করতে পারবে না। কিন্তু বাঙালিরা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে তারা বীরের জাতি। তারা কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে জানে না। এর যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীতে স্বাধিকারের দাবিতে সংঘটিত সকল আন্দোলনে। বাঙালিরা ৫৪ এর নির্বাচনে, ৬৬-এর ছয়-দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১ এর মহান যুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় আসীন করে যা বিশ্বের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১৫. অধিকার আদায়ের শিক্ষা : রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষকে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের শিক্ষা দেয়। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের ফলে তা অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বিশেষ করে পাকিস্তান স্বাধীনতার পর পর ভাষাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানিদের মনোভাব বাঙালিদের মনে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার সৃষ্টি করে। বাঙালি ছাত্র ও তরুণ সমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলার জনগণ পরবর্তীতে অন্যান্য অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সচেতন হয়ে উঠে ।
১৬. পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এ আন্দোলনের পরবর্তীতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যত আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোতে আন্দোলনকারীদের প্রেরণা যুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে বাঙালিরা যতগুলো আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছে সবগুলোতেই (যেমন-৫৪ এর নির্বাচন, ৬৬-এর ছয়-দফা কর্মসূচি, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ) বাঙালিরা জয়লাভ করেছে। সুতরাং বলা যায় যে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন ছিল পরবর্তী সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বে ভাষার জন্য বাঙালিদের মতো আর কোনো জাতিকে আত্মাহুতি দিতে হয়নি। এজন্যই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে খ্যাত। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তাই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন অগ্রগামী আন্দোলন, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।