পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র |
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র
- পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান যে আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় তা বর্ণনা কর।
- অথবা, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আলোচনা কর ।
- অথবা, পাকিস্তানের দুই অংশের আর্থসামাজিক বৈষম্য আলোচনা কর।
- অথবা, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে যে আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় তা আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে শোষণ ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায় । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে তাই সৃষ্টি হয় বৈষম্যের গগনচুম্বী প্রাচীর। পাকিস্তানি শাসনামলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
→ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করবে, এ চুক্তিতে পাকিস্তান न প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে তার প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার থেকে সব সময় বঞ্চিত করে। ফলে অবহেলিত দরিদ্র, পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তির । পথ খুঁজতে থাকে। কেননা আর্থসামাজিক মুক্তির প্রত্যাশায় পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ বাস্তব ও কার্যকরী অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রদানে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের হিংস্র থাবায় আবদ্ধ করে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু করে। পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান ভয়বাহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। প্রাদেশিক সরকারের হাতে মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতা ছিল না। কেন্দ্র সরাসরি এসব নিয়ন্ত্রণ করতো বলে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। স্টেট ব্যাংকসহ প্রায় সকল ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি প্রধান এবং বিদেশি মিশনসমূহের হেড অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে অবাধে অর্থ পাচার সহজ হয়। পূর্বাঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ | যোগানের ব্যাপারটি ছিল পশ্চিমের দয়ার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকতো, যে কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কখনো মূলধন গড়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের জন্য বিভিন্ন পন্থা অনুসরণ করে । তন্মধ্যে জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ বণ্টনে বৈষম্য অভ্যন্তরীণ ঋণ বরাদ্ধে বৈষম্য, আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণ, দুই অঞ্চলের বাণিজ্য ঘাটতি, মুনাফা ও মূলধন আহরণের মাধ্যমে শোষণ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শোষণ, অবকাঠামোগত বৈষম্য ও সম্পদ পাচারের মাধ্যমে শোষণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
→ পাকিস্তানের আর্থসামাজিক বৈষম্য : পাকিস্তানে দু'অঞ্চলের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য প্রকট রূপ লাভ করেছিল। সরকারের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিকল্পনাগত বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানে দু'অঞ্চলের সমাজ জীবন ছিল দুরকম। শাসক মহলের উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালিদেরকে অভাব অনটনে আর রোগগ্রস্ত রাখতে পারলে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবে না। এজন্য কৌশলে পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের মধ্যে পার্থক্য বাজায় রাখা হতো এবং তা বাঙালিদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা করা হতো। পশ্চিম পাকিস্তানে চালের দাম ছিল ১৮ টাকা মণ, পূর্ব পাকিস্তানে ৫০ টাকা মণ, গম পশ্চিম পাকিস্তানে ১০ টাকা মণ, পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫ টাকা মণ। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, ডাকঘর, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি সুবিধা ভোগ করত। আবার বিভিন্ন সমাজে কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল পশ্চিমাদের সেবার লক্ষ্যে। যুব সমাজের উন্নতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ফলে সার্বিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের শিক্ষিত করে তোলার মাধ্যমে শাসক ও শোষকশ্রেণি গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তাদের ভয় ছিল বাঙালিরা শিক্ষিত হলে চাকরিসহ প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে এবং দেশ শাসনে অংশীদারিত্ব দাবি করবে। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা যেখানে বৃদ্ধি পাচ্ছিল সেখানে আনুপাতিক হারে স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল। কিন্তু একই সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪ গুণ। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণ। ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত এই ২০ বছরে এখানকার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় মাত্র ৫গুণ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বৃদ্ধি পায় ৩০ গুণ। এভাবে শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে এগিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা বাবদ অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়তে থাকে। ১৯৪৮-৫৫ সময়কালে শিক্ষাখাতে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে বরাদ্দ দেওয়া ১,৫৩০ কোটি টাকা, সেখানে পূর্ব পাকিস্ত নিকে দেয়া হয় ২৪০ কোটি টাকা (১৩.৫%)। অপর আরেক তথ্য অনুযায়ী ১৯৫১-১৯৬১ সালে শিক্ষাখাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য মাথাপিছু বার্ষিক বরাদ্ধ ছিল ৫.৬৩ টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য তা ৮.৬৩ টাকা অর্থাৎ ব্যবধান ৫৩% এর বেশি । তাছাড়া Colombo plan, Ford Foundation, Commonwealth Aid-প্রভৃতি প্রোগ্রামের আওতায় যে সকল বৈদেশিক বৃত্তি দেয়া হয় তার সুযোগ-সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করে । পূর্ব পাকিস্তানের যোগ্য প্রার্থীরা অনেক সময় এসব বৃত্তির সন্ধানই পেত না। শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্ধের ক্ষেত্রে এরূপ বৈষম্যমূলক . নীতি অনুসরণ করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা প্রসারের গতি ছিল অত্যন্ত শ্লথ। ফলে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে সকল দিক দিয়েই শাসন ও শোষণ করেছে। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কলোনিতে পরিণত করেছে। যার ফলে পূর্ববাংলার জনগণ অত্যাচারের অতিষ্ঠ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজেদেরকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয় ।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।