আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর |
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ফলাফল আলোচনা কর
- অথবা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর
উত্তর ভূমিকা : পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য একের পর এক সংগ্রাম শুরু করে। এই সকল ন্যায্য দাবি ও অধিকারকে দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্ৰীয় সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ।
→ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ : নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. সংবাদপত্র ও মৌলিক অধিকার হরণ : আইয়ুব খান সরকার সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জনগণের মতামত প্রকাশের পথ বন্ধ করে এবং মৌলিক অধিকার হরণ করে, যার ফলে তীব্র গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় যা দমনের জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয় ।
২. ছয়-দফা কর্মসূচি : ছয়-দফা বাঙালির মুক্তিসনদ। বাঙালির বেঁচে থাকার দাবি ছিল ছয়-দফা। ছয়-দফা দাবির ফলে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তা দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পাকিস্তান সরকার ছয়-দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও পাকিস্তান ভাঙনের দাবি বলে ঘোষণা করে। ছয়-দফা দাবি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উপেক্ষিত হলে পূর্ব- বাংলার জনগণ তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে।
৩. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নির্মূল করা : পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির ফলে পূর্ব-বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। যা আইয়ুব সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
৪. শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কারণ ছিল শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। শেখ মুজিব সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সুদৃঢ় করে। যা পাকিস্তানির কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কারণ ।
৫. শোষণ অব্যাহত রাখা : এসময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যে, শেখ মুজিবকে দমন করতে না পারলে তাদের অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সবই বন্ধ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন করে তারা শাসন, শোষণ অব্যাহত রাখতে চায়
৬. গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করা : ছয়-দফাভিত্তিক আন্দোলন যখন সর্বস্তরে প্রসার লাভ করেছিল তখনই সরকার রবীন্দ্রসংগীত ও পহেলা বৈশাখ নিষিদ্ধ এবং আরবি হরফে বাংলা চালুর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আন্দোলনের গতি বহুগুণে বেড়ে যায়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান ছয়-দফা আন্দোলন এক গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকার এ গণআন্দোলনের দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর এরই ধারাবাহিকতায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উত্থাপন করা হয় ।
→ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল : শেখ মুজিবসহ বাঙালি অন্যান্য নেতা ও সামরিক লোকদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে যে মামলা করা হয় তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তবে এই মামলার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। নিম্নে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই মামলার শুরুর দিকে শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইয়ুব সরকার ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবকে সরাসরি এই মামলায় অভিযুক্ত করেন এবং তাকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। মামলায় শেখ মুজিবকে অন্তর্ভুক্তকরণে বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং শেখ মুজিব অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়। এই মামলার ফলেই শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধি লাভ করেন ।
২. গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত : ১৯৬৯ সালে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। ১৯৬৮ সালে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সরকার যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তখন থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলন খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এই মামলার ফলেই সকল শ্রেণি, পেশার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জনগণের এই সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধতা ব্যাপক গণআন্দোলনের জন্ম দেয় এবং এরই ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ মুষ্টি পরবর্তীতে আর বিচ্ছিন্ন হয়নি।
৩. মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদান : প্রবল গণঅভ্যুত্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ঐদিনই জনতার চাপে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়
৪. গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন : জনতার ছয়-দফা ও ছাত্রসমাজের এগারো দফার ফলে গোটা দেশ যখন আন্দোলনের গণমঞ্চে পরিণত হয় ঠিক সেই সময়ে ১৯৬৯ সালের ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের ৮টি রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বা DAC গঠন করে। এই গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ ৮ দফা ঘোষণা করেন এবং এই ৮ দফাভিত্তিক দাবি নিয়ে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
৫. মামলা প্রত্যাহার আইয়ুব সরকারের পতন : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে গোটা দেশব্যাপী যে স্বাধীনতাকামী ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় আইয়ুব সরকার তার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় এবং ব্যাপক গণআন্দোলনের চাপে। আইয়ুব সরকার নিরূপায় হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং এই মামলায় অভিযুক্ত সকল আসামিদেরকে মুক্তি প্রদান করেন। কিন্তু তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি। বস্তুত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে যে, গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তাতে পাকিস্তানের যেই সমরিক শাসক আইয়ুব খান ও তার দোসর মোনায়েম খানের পতন ঘটে।
৬. আইয়ুব খানের পতন : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে আইয়ুব খান রাজনীতি থেকে বিদায় নেন ।
৭. ১৯৭০-এর নির্বাচন : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ নির্বাচনে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিকে পরিষদে উভয় ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২টি এবং জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন লাভ করে। যা পাকিস্তান ভাঙনের সুস্পষ্ট আলামত হয়ে উঠে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ও বাংলাদেশের স্বাধীতনার প্রেক্ষাপট সৃষ্টির ক্ষেত্রে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলার ফলে বাঙালি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশে তার স্বাধীনতার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ তাদের ঐক্যবদ্ধতার পুনরায় পরিচয় দেয় এবং সবশেষে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একসময় আমরা অর্জন করি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।