১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর |
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর
- ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ কী ছিল?
- ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল লিখ। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ উল্লেখ কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৬৯ সালে ২৫ মার্চ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়। এ নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল লক্ষণীয়।
নির্বাচনি ফলাফল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পূর্বাঞ্চলকে একটি পৃথক অঞ্চল হিসেবে প্রমাণ করে, যা ছিল ছয়দফা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় এবং এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম-শাসকবর্গ তাদের কর্তৃত্বের বৈধতা হারায়-- যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে।
→ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল: ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। যে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কথা কল্পনাই ছিল না সেই আওয়ামী লীগই নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নিচে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করা হলো :
১. জাতীয় পরিষদের নির্বাচনি ফল : জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন লাভ করে। বাকি দুটি আসনে নির্বাচিত হন পিডিপির নুরুল আমিন এবং নির্দলীয় ত্রিদির রায়।
পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের মধ্যে পিপিপি মোট ৮৩ টি আসন লাভ করে। ফলে জাতীয় পরিষদে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগ মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে পিপিপি মোট ৮৮ টি আসন লাভ করে দ্বিতীয় স্থানে থাকে।
এছাড়া মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ৯টি, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ৭টি, জমিয়ত উল-উলেমা-ই ইসলাম ৭টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী) ৭টি, জামায়েত-ই ইসলামী ৪টি, মুসিলম লীগ। (কনভেনশন) ২টি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র ১৪টি আসন লাভ করে।
২. প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ফল : প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল আসনে জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৩১০টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
এছাড়া পিডিপি ২টি, ন্যাপ (ওয়ালী) ১টি, জামায়েত ইসলামী ১টি, নেজামে ইসলামী ১টি, স্বতন্ত্র বা নির্দলীয় ৭টি আসলে জয়লাভ করে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ভুট্টোর পিপলস পার্টি জয়ী হয়। তারা জাতীয় পরিষদের ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮ টি আসন দখল করতে সমর্থ হয়।
৩. আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
ভোটের ফলাফলে দেখা যায় মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে ৭৫.১০% এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৭০.৪৮% ভোট পায় ।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসন না পেলেও দুই পাকিস্তান মিলিয়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।।
৪. পিপলস পার্টির পরাজয় : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখা যায় পিপলস পার্টি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়।
তারা আওয়ামী লীগের নিকট তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। তবে লক্ষণীয় বিষয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোন আসন লাভ করতে পারেনি- যা পাকিস্তানের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ ।
৫. জাতীয়তাবাদের ধারণা/ বিপর্যস্ত : নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে উঠেছে।
কেননা এ নির্বাচনে আওয়ামী | লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এবং পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও কেউই নিজ অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলে একটি আসনও পায়নি। এই ফলাফল জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকে বিপন্ন করে তোলে ।
৬. ছোট দলগুলোর আসন সংকট : জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় নির্বাচনে ছোট ছোট দলগুলোর দারুণ বিপর্যয় লক্ষ করা যায়।
নির্বাচনি ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় লীগ, গণমুক্তি দল, পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ইসলামি গণতন্ত্র দলের ৪৬ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসন পায়নি। যা ছোট ছোট দলগুলোর বিপর্যয়ের চিত্রই তুলে ধরে।
৭. আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনি ফলাফল থেকে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
কেননা তারা জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং অধিকাংশ জনগণের সমর্থন লাভ করে।
অন্যদিকে পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও জনসমর্থন হারাতে থাকে। যে কারণে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮৮টি আসন লাভ করে।
→ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ : বিস্ময়করভাবে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে।
তাদের এ সাফল্যের পিছনে বেশ কিছু উপাদান ভূমিকা রেখেছিল। নিম্নে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ উল্লেখ করা হলো :
১. নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন : আওয়ামী লীগের নির্বাচনের ইশতেহারে ছয় দফাভিত্তিক দাবি পূর্ব বাংলার জনসাধারণকে আকৃষ্ট করেছিল।
বস্তুত এসব দাবি ছিল এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি এবং নির্বাচনের পূর্বেই এসব দাবি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ফলে নির্বাচনে জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মূলত তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। যে কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
২. পশ্চিমা শোষণের প্রভাব : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমাঞ্চলের শাসকবর্গ নানা উপায়ে পূর্বাঞ্চলকে শোষণ করেছে।
এ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ দিয়েছে। তাই নির্বাচনে পশ্চিমা দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে তারা এসব শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ তুলে ধরেছে।
আর পশ্চিমা শোষণের প্রভাব জনগণ থেকে নির্বাচনের ওপর পড়েছে। যে কারণে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে।
৩. শেখ মুজিবের নির্বাচনি প্রচারণা : ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের বন্যায় এ অঞ্চলে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়।
শেখ মুজিব বন্যার্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও সরকারের ব্যর্থতা প্রচার করে জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সফলতা অর্জন করে ।
৪. শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব : শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ইমেজ আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সবার প্রিয় এবং বক্তা হিসেবে সবার ঊর্ধ্বে।
তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে।
৫. ভুট্টোর জনবিরোধী ভূমিকা : ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের প্রতি অনুগত না হয়েও ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করে ভুট্টো পাকিস্তানের ইসলামপন্থিদের সমর্থন পাননি।
অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মুসলমান। ফলে তারা ভুট্টোর ইসলামি প্রচারণার বিপরীতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল- যা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সহায়তা করে।
৬. জাতীয়তাবোধের প্রভাব : ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্বা বাংলায় যে স্বাতন্ত্র্যবাদ ও পৃথক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল ৭০ সালের নির্বাচনে তা আওয়ামী লীগের পক্ষেই ভূমিকা রেখেছিল। অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাব ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পড়েছিল।
যে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি, এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মূলত অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাব আওয়ামী লীগের বিজয়ের পিছনে ভূমিকা রেখেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য যেমন চমকপ্রদ তেমনি বিস্ময়কর। এ নির্বাচনে তথাকথিত ধারার অবসান ঘটিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে তোলে।
এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বাঞ্চলে শাসন করার বৈধতা হারায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পশ্চিমা গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করে।
আওয়ামী লীগের এ বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরো সুদৃঢ় করে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয় হয়। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।