১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য |
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর
- ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর। কেন এ সংবিধান ব্যর্থ হয়েছিল?
উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান হিসেবে ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও এর সংবিধান রচিত হয় ১৯৫৬ সালে। অর্থাৎ দীর্ঘ ৯ বছরের মধ্যে পাকিস্তান জনগণকে কোনো সংবিধান উপহার দিতে পারেনি। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায় গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ তা ভেঙে দিয়ে ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ হতে তা কার্যকর করা হয়।
— ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রধান বৈশিষ্ট্য : ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তান সংবিধানের মূল্য বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হলো :
১. লিখিত সংবিধান : ১৯৫৬ সালের প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধান ছিল একটি লিখিত দলিল ।
২. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : এ সংবিধান ছিল একটি দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। জাতীয় পরিষদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংশোধনী বিল উত্থাপন করা গেলেও তা পাস করতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটের প্রয়োজন হতো।
৩. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : এ সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলেও এতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রবর্তন করা হয় ।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেয়া হয়।
৫. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা : এ সংবিধানে পাকিস্তানে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা ও অন্যান্য নির্বাচিত সংস্থার সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় ।
৬. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার : এ সংবিধানে কেন্দ্রে ও প্রদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয় এবং মন্ত্রিপরিষদকে আইন পরিষদের নিকট দায়ী রাখা হয়।
৭. ইসলামি প্রজাতন্ত্র : এ সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। সংবিধান অনুযায়ী কোনো অমুসলমান রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না এবং সব আইন কুরআন ও সুন্নাহের অনুযায়ী হবে।
৮. প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান প্রেসিডেন্ট ছিলেন নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান।
৯. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের প্রদেশ দুটোতে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হলেও প্রাদেশিক শাসনবিভাগ সংশ্লিষ্ট আইনসভার নিকট দায়ী থাকত।
১০. মৌলিক অধিকার : এ সংবিধানের সমগ্রদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত করা হয়। নাগরিকদের অনুরোধক্রমে আদালতকে এসব অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দেয়া হয়।
১১. সমতার নীতি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সমতার নীতি বাস্তবায়ন করে দুটো অংশের মাঝে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য রোধ করা হয় এবং সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
১২. বিচার বিভাগ : এ সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। একটি সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একটি করে হাইকোর্ট এবং নিম্নতর পর্যায়ে অন্যান্য অধঃস্তন আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : সংবিধানে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গঠন করা হয় । এর নাম দেয়া হয় ‘পাকিস্তান সর্বোচ্চ আদালত' ।
১৪. দুটি রাষ্ট্রভাষা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়। এতে সাময়িকভাবে ইংরেজি বলবৎ থাকে।
১৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা : এ সংবিধানে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করা হলেও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণের বিধান করা হয়।
১৬. জরুরি বিধান : এ সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়। জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারতেন।
১৯. সার্বজনীন ভোটাধিকার : এ সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয় ।
→ ১৯৫৬ সালের সংবিধানের/সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণ : নিম্নে কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. রাষ্ট্রপ্রধানের অবৈধ হস্তক্ষেপ : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রধান কারণ রাষ্ট্রপ্রধানের অবৈধ হস্ত ক্ষেপ। পাকিস্তান রাষ্ট্রপ্রধানগণ ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতো। রাষ্ট্রপ্রধানগণ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাও মেনে চলতো না। গণপরিষদের আস্থাভাজন থাকা সত্ত্বেও গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ মুসলিম লীগের দুর্বলতার সুযোগে খাজা নাজিম উদ্দিনের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছিলেন। আবার ইস্কান্দার মীর্জাও প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দীকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণে সুযোগ না দিয়ে বরখাস্ত করেন।
২. সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব : সংসদীয় সরকারের সাফল্য নির্ভর করে সুষ্ঠু ও সময়োচিত নির্বাচনের উপর। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে যতদিন সংসদীয় শাসন চালু ছিল, ততদিন পর্যন্ত সেখানে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচনের জন্য কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানে প্রথম ও দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল পরোক্ষ নির্বাচনের দ্বারা ।
৩. কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ : কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার অহেতুক হস্তক্ষেপ করতো। যার ফলে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বাধার সম্মুখীন হয়। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ এ শুভ সূচনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
৪. ইস্কান্দার মীর্জার ক্ষমতা লিপ্সা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ইস্কান্দার মীর্জার ষড়যন্ত্রও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। সংসদীয় ব্যবস্থা তার জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে মনে করে তিনি সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের সংবিধান ও সংসদীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়।
৫. যোগ্য নেতৃত্বের অভাব : তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে লালন করার মতো পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি। তাই ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রবর্তিত সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।
৬. রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লিপ্সা : সে সময়ে রাজনীতিবিদগণ প্রায় ক্ষমতার লোভে রাতারাতি দল পরিবর্তন করতেন এবং নতুন নতুন দল সৃষ্টি ও উপদলীয় কোন্দলের জন্ম দিতেন। ফলে সংসদীয় পদ্ধতি ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হয়।
৭. আঞ্চলিক বিরোধ : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই নানা | কারণে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের চরম অবজ্ঞা ও উপেক্ষার চোখে দেখতো। তাছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদেরও কোনো মর্যাদা তারা দিত না। সুতরাং দেখা যায়, আঞ্চলিক বিরোধই সংসদীয় সরকারের ব্যর্থতার মূল কারণ ।
৮. সাংবিধানিক ত্রুটি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা বণ্টন এবং ক্ষমতার সীমা | সম্পর্কে বেশ কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছিল। ফলে এ সংবিধান ব্যর্থতার পথে নিমজ্জিত হয়।
৯. রাজনৈতিক অস্থিরতা : তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিস্বার্থ, দুর্নীতি, শৃঙ্খলার অভাব, নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো স্থিরতা ছিল না। যার ফলে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা আত্মপ্রকাশে ব্যর্থ হয়।
১০. অন্যান্য কারণ : পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে তিক্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, গণপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় আইনসভারূপে নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদের ব্যর্থতা, শাসন বিভাগের উপর আইনসভার প্রাধান্য স্থাপনে অক্ষমতা, পরমত সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সংসদীয় নিয়মনীতির অভাব ইত্যাদি কারণেও সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় বছর পরে পাকিস্তানে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে যায়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা উক্ত সংবিধানের অধীনে কোনো নির্বাচন হওয়ার পূর্বেই এ সংবিধানকে বাতিল করে দেন। ফলে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।