ক্রায়োসার্জারি কি | ক্রায়োসার্জারির সুবিধা ও অসুবিধা
ক্রায়োসার্জারি কি | ক্রায়ােসার্জারি (Cryosurgery) | ক্রায়োসার্জারি চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর
ক্রায়ােসার্জারি হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় শরিরের অস্বাভাবিক ও রোগাক্রান্ত কোসগুলোকে ধ্বংস করা যায়। গ্রিক শব্দ ‘ক্রায়াে' (বরফের মতাে ঠাণ্ডা) এবং ‘সার্জারি (হাতের কাজ) শব্দ দুটি হতে ক্রায়ােসার্জারি শব্দটি এসেছে। ঐতিহাসিকভাবেই বেশ কিছু রােগের চিকিৎসার জন্য ক্রায়ােসার্জারিকে ব্যবহার করা হতাে, যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক চর্ম সংক্রান্ত সমস্যাও রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের দিকে মিশরীয়রা ত্বকের বিভিন্ন ধরনের ক্ষত ও প্রদাহের চিকিৎসায় শীতল তাপমাত্রা ব্যবহার করতাে।
কত তাপমাত্রায় ক্রায়োসার্জারি করা হয়
জেমস আরনট কর্তৃক মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় লবণ পানিকে বরফে জমাকৃত করে ব্যবহার করার পদ্ধতি বর্ণিত হওয়ার মাধ্যমে ১৮৪৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ক্রায়ােসার্জারির । ব্যবহার শুরু হয়। তবে তুকের চিকিৎসায় ক্রায়ােসার্জারির ব্যাপক প্রয়ােগ শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে। শিকাগাের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ক্রায়ােসার্জারিতে প্রথম কার্বন ডাই অক্সাইডের ব্যবহার প্রবর্তন করেন এবং তার পর । ক্রায়ােসার্জারির কাজে কার্বন ডাই অক্সাইডের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হতে থাকে।
ক্রায়োসার্জারি কি ক্রায়োসার্জারির সুবিধা ও অসুবিধা |
ক্রায়োসার্জারিতে ব্যবহৃত প্রধান উপাদান কী কি | ক্রায়োসার্জারিতে কোন কোন গ্যাস ব্যবহৃত হয়
১৯২০ সালের দিকে ক্রায়ােসার্জারিতে তরল অক্সিজেনের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ সালে ড. রে এলিংটন ক্রায়ােসার্জারিতে তরল নাই কােন প্রয়ােগ করেন। আধুনিক ক্রায়ােসার্জারির পথ চলা শুরু হয় ডঃ ইরভিং কুপার এর হাত ধরে। পরবর্তীতে অন্যান্য ক্রায়ােজনিক এজেন্ট যেমন— নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্গন, ইথাইল ক্লোরাইড এবং ফোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন ব্যবহার করে ক্রায়ােসার্জিক্যাল চিকিৎসায় আরাে উন্নতি সাধন করা হয়। যে তাপমাত্রায় বরফ জমাট বাঁধে, দেহকোষে তার চেয়েও নিম্ন তাপমাত্রার ধ্বংসাত্মক শক্তির সুবিধাকে গ্রহণ করে ক্রায়ােসার্জারি কাজ করে। এতে নিম্ন তাপমাত্রায় দেহকোষের অভ্যন্তরস্থ বরফ ক্রিস্টালগুলাের বিশেষ আকার বা বিন্যাসকে ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দেয়া যায়। ক্রায়ােসার্জারির ক্ষেত্রে সাধারণত পৃথক পৃথকভাবে তরল নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুষার, আর্গন এবং সমৰিত আৰে ডাইমিখাইল ইথার ও প্রােপেন এর মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এদের কোনাে কোনােটি ) তাপমাত্রার উদ্ভব ঘটায়। পাশের ছকে ক্রায়ােসার্জারিতে ব্যবহৃত গ্যাস ও তাদের তাপমাত্রা প্রদর্শিত হলাে।
ক্রায়ােসার্জারির ব্যবহার
১. ওয়াট, মােল, স্ক্রিন ট্যাগ, সােলার কেরাটোস, মর্টনস নিউরােমা এবং ছােটোখাটো চর্ম ক্যান্সারসমূহের জন্য ক্রায়ােসার্জিক্যাল চিকিৎসা দেয়া হয়।
২. বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ শারীরিক ব্যাধি যেমন- লিভার ক্যান্সার, প্রােস্টেট ক্যান্সার, লাং ক্যান্সার, ওরাল ক্যান্সার, সাভিক্যাল ব্যাধিসমূহের চিকিৎসায় ক্রায়ােসার্জারি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৩. মানবদেহের কোষকলার কোমল অবস্থা যেমন- প্ল্যান্টার ফ্যাসিলিটিজ এবং ফিরােমাকে ক্রায়ােসার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়।
ক্রায়োসার্জারি প্রয়োগ
চিকিৎসায় ক্রায়ােসার্জারি প্রয়ােগের বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। “ক্রায়ােসার্জারির মাধ্যমে রক্তপাতহীন অপারেশন সম্ভব”—কারণ নিম্নোক্ত সুবিধাসমূহ বিশ্লেষণ করলেই এর সত্যতা নিরূপণ করা যাবে ?
১. ক্রায়ােপ্রােবের সুচের প্রান্ত দিয়ে আক্রান্ত টিস্যু বা টিউমারের কোষকে বরফ শীতল তাপমাত্রায় জমাটবদ্ধ করার জন্য তরল নাইট্রোজেন, আর্গন বা অন্যান্য ক্রায়ােজনিক এজেন্ট পৃথক পৃথকভাবে ঐ স্থলে প্রবেশ করানাে হয়। এগুলাের কোনাে কোনটি -৪১° ডিগ্রি তাপমাত্রার উদ্ভব ঘটায়; যার ফলে আক্রান্ত কোষ বা টিস্যুর পানি জমাটবদ্ধ হয়ে সেটিকে একটি বরফ খণ্ডে পরিণত করে। এ সময় আক্রান্ত কোষ বা টিস্যুতে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার কারণে উক্ত কোষ বা টিসুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর পুনরায় ঐ স্থানে ক্রায়ােপ্রােবের সাহায্যে হিলিয়াম গ্যাস প্রবেশ করিয়ে এই তাপমাত্রাকে ২০ থেকে ৩০° পর্যন্ত ওঠানাে হয়। এতে আক্রান্ত কোষ বা টিস্যুটির বরফ গলে গিয়ে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আক্রান্ত স্থানে সুনির্দিষ্ট কোষ বা টিস্যুকে নিখুতভাবে চিহ্নিত করার জন্য আলট্রা সাউন্ড বা এমআরআই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ফলে এর আশেপাশে থাকা সুস্থ কোষগুলাের কোনাে ক্ষতি হয় না।
২ ক্রায়ােসার্জারি চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রচলিত শল্য চিকিৎসার মতাে অতটা কাটাছেড়া করার প্রয়ােজন হয় না।
৩. এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।
৪. এ পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে কেমােথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং অস্ত্রোপচার চিকিৎসার জায়গা দখল করে নিচ্ছে। ফলে ক্যান্সার ও নিউরাে রােগীদের কাছে দিন দিন এর গ্রহণযােগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।।
৫. সকল ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় এ পদ্ধতি চিকিৎসকদের বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। নিউরােসার্জারি এবং টিউমার বা ক্যান্সার রােগের চিকিৎসায় ক্রায়ােথেরাপি পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর।
ক্রায়ােসার্জারি ও রেডিওথেরাপির মধ্যে পার্থক্য
ক্রায়ােসার্জারি | রেডিওথেরাপি |
---|---|
১. এ থেরাপির ক্ষেত্রে রােগীকে তুলনামূলকভাবে কম ধকল সহ্য করতে হয়। | ১. এ থেরাপির ক্ষেত্রে রােগীকে অনেক বেশি ধকল সহ্য করতে হয়। |
২. এটি অনেক নিরাপদ পদ্ধতি ও প্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। | ২. এ থেরাপিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। |
ক্রায়ােসার্জারিতে আইসিটির ব্যবহার (Using ICT in Crysurgery)
- ক্রায়ােসার্জারিতে সুঁইয়ের মতাে লম্বা ক্রায়ােপ্রােব যন্ত্রের সাহায্যে আক্রান্ত টিউমারে নাইট্রোজেন ও আর্গন গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ক্রায়ােপ্রােব সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং পাশের সুস্থ কোষ যাতে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত আলট্রাসাউন্ড অথবা এমআরআই (MRI-Magnetic Resource Image) ব্যবহার করা হয়।
- ব্রায়মিল হলাে পৃথিবীর মধ্যে নাম্বার ওয়ান হ্যান্ডহ্যান্ড লিকুইড খবার মধ্যে নাম্বার ওয়ান হ্যান্ডহ্যান্ড লিকুইড নাইট্রোজেন ক্রায়ােসার্জিক্যাল এবং ক্রায়ােস্ত্রে ডিভাইস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থায় কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে।
- ক্রায়ােসার্জারি উৎপাদনে কাচামাল সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদি থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন, বিপণন সর্বত্রই তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
- ক্রায়ােসার্জারির জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার তৈরিতে ভাৰ্চয়্যাল রিয়েলিটির প্রয়ােগ করা হয়।
ক্রায়ােসার্জারির সুবিধা:
১. ক্যান্সারের চিকিৎসায় অন্য সব পদ্ধতির চেয়ে ক্রাইয়ােসার্জারি অনেক বেশি সুবিধাজনক। প্রকৃত সার্জারির চেয়ে এটি কম আক্রমণকারী; চামড়ার ভেতর দিয়ে ক্রায়ােপ্রােব ঢুকানাের জন্য অতি ক্ষুদ্র ছেদনের প্রয়ােজন পড়ে।
২. সার্জারির ক্ষেত্রে ব্যথা, রক্তপাত এবং অন্যান্য জটিলতাসমূহকে ক্রায়ােসার্জারিতে একেবারেই কমিয়ে আনা হয়।
৩. অন্যান্য চিকিৎসার চেয়ে এটি কম ব্যয়বহুল এবং সুস্থ হতেও খুব কম সময় নেয়।
৪. হাসপাতালে খুবই স্বল্প সময় অবস্থান করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে থাকতেই হয় না।
৫, অনেক সময় লােকাল অ্যানেসথেসিয়ার মাধ্যমেই ক্রায়ােসার্জারি সম্পন্ন করা যায়।
৬. চিকিৎসকগণ শরীরের সীমিত এলাকায় ক্রায়ােসার্জিক্যাল চিকিৎসা দেন, ফলে তারা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যবান কোষকলাকে | ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।
৭. এ চিকিৎসাটি নিরাপদে বার বার করা যায় এবং সার্জারি, কেমােথেরাপি, হরমােন থেরাপি ও রেডিয়েশনের মতাে স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসার পাশাপাশি করা সম্ভব।
৮. যেসব রােগীরা তাদের বয়স এবং অন্যান্য শারীরিক কারণে স্বাভাবিক সার্জারির ধকল নিতে অক্ষম তাদের জন্য ক্রায়ােসার্জারি হলাে আদর্শ।
ক্রায়ােসার্জারির অসুবিধা:
১. ক্রায়ােসার্জারির প্রধানতম অসুবিধা হলাে এর দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতার অনিশ্চয়তা।
২. ইমেজিং পরীক্ষাসমূহের মাধ্যমে চিকিৎসকগণ টিউমারসমূহ দেখে নিয়ে তার ক্ষেত্রে ক্রায়ােসার্জারিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলেও এটি আণুবীক্ষণিক ক্যান্সার ছড়ানােকে প্রতিহত করতে পারে না।
ক্রায়ােসার্জারির পথিকৃৎগণ
ডঃ ব্লেঅ্যালিটন (Dr. Ray Elington) : ক্রায়ােসার্জারিতে প্রথম তরল নাইট্রোজেনের ব্যবহার শুরু করেন তিনি। দ্বিতীয়। বিশ্বযুদ্ধের পর পরই তরল নাইট্রোজেনে তুলাের পুটলি ডুবিয়ে তা দিয়ে বিভিন্ন ত্বকের ক্ষতের চিকিৎসা শুরু করেন। তার এই তরল নাইট্রোজেনের প্রয়ােগ পরবর্তীতে ক্রায়ােসার্জারির জন্য তরল নাইট্রোজেনের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তােলে। বর্তমানে সব ধরনের ক্রায়ােসার্জারেিতই তরল নাইট্রোজেনের ব্যবহার হয়ে থাকে।
ডাঃ ইভিং কুপার (Dr. Iring Cupper) (1922-1985): পূর্ণ নাম ডাঃ ইরভিং এস কুপার। ক্রায়ােসার্জারির ক্ষেত্রে তার অবদান গুরুত্বের সাথে স্বীকার করা হয়। কেননা তিনিই প্রথম তুলার পুটলির পরিবর্তে লিকুইড নাইট্রজেনের প্রোব ব্যবহার করেন যা -196° তাপমাত্রা ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। এই বিশেষ ইকুইপমেন্টটি ক্রায়ােসার্জারির ক্ষেত্রে অনেক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। বর্তমানে ঐয়ে সার্জারিতে যে ক্রয়ােপ্রোব ব্যবহার হয় তা তার ব্যবহৃত ইকুইপমেন্টেরই বিবর্তিত রূপ।